ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ:
মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশি হাফেজদের আলাদা গুরুত্ব আছে। আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজরা বরাবরই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। করেছে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে সম্মানিত। তাদের অনন্য অবদানে প্রায়ই বিশ্বমিডিয়ায় শিরোনাম হচ্ছে সতেরো কোটি মানুষের ‘বাংলাদেশ’।
কাতার, কুয়েত, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, মালয়েশিয়া, ভারত, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ হচ্ছে বাংলাদেশি হাফেজরা।
সৌদি আরবের পবিত্র মক্কায় অনুষ্ঠিত ৪৩তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হাফেজ তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান লাভ করেছে। প্রতিযোগিতায় পূর্ণ কোরআন হিফজ বিভাগে তৃতীয় হয়েছেন ফয়সাল আহমেদ এবং চতুর্থ হয়েছেন মো. মুশফিকুর রহমান।সৌদি আরব স্থানীয় সময় বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) এশার নামাজের পর বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানের পক্ষ থেকে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মক্কার ডেপুটি গভর্নর প্রিন্স বদর বিন সুলতান। ৫টি বিভাগে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের সর্বমোট ৪০ লাখ সৌদি রিয়াল পুরস্কার দেওয়া হয়। এর আগে গত ২৫ আগস্ট সৌদি আরবের ইসলাম ও দাওয়াহ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মক্কায় ৪৩তম বাদশাহ আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতা শুরু হয়।এতে বিশ্বের ১১৭টি দেশ থেকে ১৬৬ প্রতিযোগী অংশ গ্রহণ করেন। উক্ত প্রতিযোগিতায় পূর্ণ কোরআন হিফজ বিভাগে তৃতীয় হয়ে হাফেজ ফয়সাল আহমেদ পুরস্কার হিসেবে ১ লাখ ৮০ হাজার সৌদি রিয়াল (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫২ লাখ ৬২ হাজার ৫৭৯ টাকা) ও সম্মাননা পদক পেয়েছেন। ফয়সাল রাজধানীর মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। হাফেজ ফয়সাল আহমেদের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায়।হাফেজ ফয়সাল আহমেদের এমন কৃতিত্বের জন্য রাজধানীর মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসার প্রিন্সিপাল শায়েখ নেছার আহমাদ আন নাছিরী দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।
অপর প্রতিযোগী হাফেজ মো. মুশফিকুর রহমান পবিত্র কোরআনের ১৫ পারা হিফজ বিভাগে অংশ নিয়েছেন। চতুর্থ হয়ে পুরস্কার হিসেবে তিনি ১ লাখ ২০ হাজার সৌদি রিয়াল (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫ লাখ ৮ হাজার ৩৮৬ টাকা) ও সম্মাননা পদক পেয়েছেন। হাফেজ মো. মুশফিকুর রহমান কক্সবাজারের মা’হাদ আন-নিবরাসে কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেছেন।
আন্তর্জাতিক এ প্রতিযোগিতার বিচারক প্যানেলে প্রথমবারের মতো ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মুহাদ্দিস হাফেজ মাওলানা ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিযোগিতার বিচারকার্য যথাযথ পালন করায় অনুষ্ঠানে তাকেও বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
গত বছর বাংলাদেশ থেকে হাফেজ সালেহ আহমদ তাকরীম প্রতিযোগিতার তাজবিদসহ অর্ধ-কোরআন হিফজ বিভাগে অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। বিজয়ী হিসেবে সে এক লাখ রিয়াল (প্রায় সাড়ে ২৭ লাখ টাকা) পুরস্কার ও সম্মাননা ক্রেস্ট লাভ করে।
সৌদি আরবের ইসলাম ও দাওয়াহ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক এ প্রতিযোগিতাটি পাঁচটি ক্যাটাগরিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো হলো: (১) শাতেবি পদ্ধতিতে সাত কিরাতসহ সুন্দর কণ্ঠে পূর্ণ কোরআন হিফজ, (২) তাজবিদসহ সুন্দর কণ্ঠে পূর্ণ কোরআন হিফজ এবং একক শব্দগুলোর তাফসির, (৩) তাজবিদসহ সুন্দর কণ্ঠে পূর্ণ কোরআন হিফজ, (৪) তাজবিদসহ ১৫ পারা হিফজ ও (৫) তাজবিদসহ পাঁচ পারা হিফজ (শেষ বিভাগটি ওয়াইসিভুক্ত নয় এমন দেশের জন্য প্রযোজ্য
পবিত্র কুরআনুল কারিম হিফজকারী তথা হাফেজরা দুনিয়াতে সম্মানিত আখিরাতেও সম্মানিত। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তাদেরকে অনেক সম্মানিত করেছেন। হাদিস শরিফে রয়েছে তাদের ব্যাপারে অনেক খোশখবর!কোরআন সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ। আল্লাহ কোরআনকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের জন্য হেদায়েতের মাধ্যম হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত রক্ষার অঙ্গীকার করেছেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমিই তার রক্ষক।’ -(সুরা হিজর, আয়াত : ৯)
হাফেজরা সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী কোরআনের ধারক। একাধিক আয়াত ও হাদিসে কোরআনের ধারক-বাহক হাফেজদের বিশেষ মর্যাদার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে নিজে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০২৮)
হাফেজে কোরআন সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং সম্মানিত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতকারীদের ব্যাপারে নবীজি (স.) জানিয়েছেন, তারা আল্লাহর পরিজন।
আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, কিছু মানুষ আল্লাহর পরিজন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা? তিনি বলেন, কোরআন তেলাওয়াতকারীরা আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা।’ -(ইবনে মাজাহ: ২১৫)
পবিত্র কোরআন হিফজ করা, চর্চা করা এতটাই ফজিলতপূর্ণ কাজ যে, রাসুল (স.) তার হিফজকারীদের ফেরেশতাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (স.) থেকে বর্ণনা করেছেন, কোরআনের হাফেজ পাঠক লিপিকর সম্মানিত ফেরেশতাদের মতো। খুব কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কোরআন পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে। (বুখারি: ৪৯৩৭)
দুনিয়াতে যারা কোরআন শিখবে এবং কোরআন অনুযায়ী আমল করবে, হিফজ করবে, কিয়ামতের দিন তাদের বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, কোরআন কেয়ামত দিবসে হাজির হয়ে বলবে, হে আমার প্রভু, একে (কোরআনের বাহককে) অলংকার পরিয়ে দিন। তারপর তাকে সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তাকে আরো পোশাক দিন। সুতরাং তাকে মর্যাদার পোশাক পরানো হবে।
সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। কাজেই তিনি তার ওপর সন্তুষ্ট হবেন। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি একেক আয়াত পাঠ করতে থাকো এবং ওপরের দিকে উঠতে থাকো। এমনিভাবে প্রতি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব (মর্যাদা) বাড়ানো হবে। (তিরমিজি: ২৯১৫)
পবিত্র কোরআন হেফজ করতে পারা আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত সমূহের মধ্যে অন্যতম। এই নেয়ামতের ব্যাপারে ঈর্ষা করাও জায়েজ। রাসুল (স.) বলেছেন, দুই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ঈর্ষা করা যায় না।
এক ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং সে তা দিন-রাত তেলাওয়াত করে। আর তা শুনে তার প্রতিবেশীরা বলে, হায়! আমাদের যদি এমন জ্ঞান দেওয়া হতো, যেমন অমুককে দেওয়া হয়েছে, তাহলে আমিও তার মতো আমল করতাম। অন্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন এবং সে সত্য ও ন্যায়ের পথে সম্পদ খরচ করে। এ অবস্থা দেখে অন্য এক ব্যক্তি বলে, হায়! আমাকে যদি অমুক ব্যক্তির মতো সম্পদ দেওয়া হতো, তাহলে সে যেমন ব্যয় করছে, আমিও তেমন ব্যয় করতাম।’ (বুখারি: ৫০২৬)
কেয়ামতের দিন কোরআনের হাফেজদের মা-বাবাকে বিশেষ সম্মান দেবেন আল্লাহ তায়ালা। এ বিষয়ে হজরত সাহল ইবনু মুআজ আল-জুহানি (রহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন-
রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করে এবং তা অনুযায়ী আমল করে, কেয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে এমন মুকুট পরানো হবে যার আলো সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল হবে। ধরে নাও, যদি সূর্য তোমাদের ঘরে বিদ্যমান থাকে (তাহলে তার আলো কিরূপ হবে?)। তাহলে যে ব্যক্তি কোরআন অনুযায়ী আমল করে তার ব্যাপারটি কেমন হবে, তোমরা ধারণা করো তো!’ (আবু দাউদ: ১৪৫৩; শুআবুল ঈমান: ১৭৯৭)
নবীজি (স.) সাহাবায়ে কেরামকে কোরআনের ধারক-বাহকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। যারা ৩০ পারা কোরআন হেফজ করে তা ধরে রাখে, তার ওপর আমল করে, তারাও সেই সম্মানের যোগ্য। আবু মুসা আল-আশআরি (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কোরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (আবু দাউদ: ৪৮৪৩)এভাবে হাফেজদের জন্য অনন্য মর্যাদার কথা বলে গেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। আল্লাহপাক আমাদের ও আমাদের সন্তানদের হাফেজ হওয়ার তওফিক দান করুন এবং হিফজের গুরুত্ব বোঝার তাওফিক দান করুন। আমিন।
পরিশেষে বলতে চাই,মুখস্থ করার অভ্যাস সবার সমান নয়। সে হিসেবে বলা যায়, যারা পবিত্র কোরআনে কারিম মুখস্থ করেন তারা অবশ্যই প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী।একজন হাফেজে কোরআন পরকালে বিশেষ সম্মানে ভূষিত হবেন। দুনিয়াতেও হাফেজে কোরআনকে দেয়া হয় বিশেষ সম্মান ও মার্যাদা এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন উদ্যোগে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বেশ কয়েকটি দেশে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বমানের হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা।
এসব প্রতিযোগিতার মূল্যমান যেমন বিশ্বমানের, তেমন এর গুরুত্বও ভিন্ন।
ইসলামি সভ্যতা বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য।
এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। রয়েছে আলাদা ঐতিহ্যও। সেই ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত বিভিন্ন হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় স্বার্থকতার সাথে অংশগ্রহণ থাকেন বাংলাদেশের হাফেজরা।
বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত প্রতিযোগিতার নাম ‘আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা। ’ এই প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বয়সী বাংলাদেশের হাফেজরা অত্যন্ত সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করে আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এসব প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা শীর্ষস্থান অধিকার করে দেশের সুনাম বয়ে আনছে। বিশ্বপরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের সুনাম ও খ্যাতি।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল, drmazed96@gmail.com