বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে অভিযুক্ত মৌলভীবাজার কারাগারের সাবেক জেলার আবু মুসা এখন কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেলার।
তদবির করে টাকার খনি কক্সবাজার জেলা কারাগারে যোগদানের পর থেকে তার নেতৃত্বে জেল সুপারের আস্কারায় কক্সবাজার জেলা কারাগার হয়ে উঠেছে অনিয়ম দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য।
জানাগেছে, জেলারের বাড়ি কুমিল্লা হওয়ায় তিনি কারা অভ্যন্তরে অনেকটা নিজের পছন্দের একটা কুমিল্লা বাহিনী গড়ে তুলছেন।
জেল সুপার এবং জেলারের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তায় চলছে বন্দি বেচা-কেনা, অবৈধ ক্যান্টিন বাণিজ্য, টেলিফোন বানিজ্য এবং বন্দীদের স্বাক্ষাৎ বানিজ্য।
এমনটা অভিযোগ উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
জানাগেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া কক্সবাজার কারাগারে বর্তমানে রাজনৈতিক বন্দী এবং ইয়াবা কারবারিদের রামরাজত্ব চলছে।
জেলার এবং জেল সুপারের পকেটে যায় মোবাইল কল বিক্রি ও কারা ক্যান্টিনের মাসিক মাসোহারার টাকা অপকর্মের হোতা জেল সুপার জাবেদ মেহেদী ও জেলার আবু মুসা নিজেই।
সু্ত্র জানায় কক্সবাজার জেলা কারাগার। এ যেন অন্য এক দুনিয়া।
চোখে না দেখলে কারাগারের ভেতরকার কাজ কারবার যে কারওর কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে। কথিত আছে, এখানে টাকা দিলে বাঘের চোখও মেলে! খাওয়া যায় মাদক থেকে শুরু করে মাংস-পোলাও।
মোবাইল ফোনে বউ থেকে শুরু করে প্রিয়জন কিংবা বন্ধুর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে নেই মানা!
বাইরে থেকে টের পাওয়া না গেলেও কারাগারের ভেতরে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
এসব অপকীর্তির হোতা জেলার আবু মুসা সহ কারগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
কারাগারটি থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া বেশ কয়েকজন বন্দির কাছ থেকে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।
জামিনে মুক্তি পাওয়া এক ব্যক্তি কারাগারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ১৫ দিন পরপর বন্দীদের স্বজনদের সাথে দেখা স্বাক্ষাতের নিয়ম থাকলেও এখানে টাকা দিলে বিশেষ কায়দায় প্রতিদিন দেখা স্বাক্ষাতের সুযোগ আছে। কথিত ভিআইপি ব্যবস্থাপনায় সবই সম্ভব। আর স্বাভাবিক সময়ে টাকা দিলেই ভিআইপি ব্যবস্থাপনা ছাড়াই স্বজনরা বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। পাশাপাশি আসামিদের জন্য বাড়ির রান্না করা খাবার ঢোকাতে পারেন।
এজন্য আছে আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা। ডেপুটি জেলারের কক্ষই সাক্ষাতের কক্ষ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
ইয়াবা সিন্ডিকেটের দখলে মোবাইল ফোন : সদ্য কারামুক্ত কয়েকজন বন্দি জানান, সরকার সাধারণ বন্দিদের জন্য কারাগারে ১৬টি মোবাইল ফোন দিয়েছে। নিয়ম অনুয়ায়ী ৫ টাকা দিয়ে প্রত্যেক বন্দি সপ্তাহে একবার পরিবারের (এক কল) সঙ্গে ১০ মিনিট করে কথা বলতে পারেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ প্রতি ১৫ দিনের জন্য দুই আড়াই লাখ টাকা জামানত (অফেরতযোগ্য) নিয়ে ৮/৯টি মোবাইলই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে।
এসব মোবাইলের ভাড়া বাবদ আদায় করা হয় দৈনিক ৭০/ ৮০ হাজার টাকা।
ওই মোবাইলে কথা বলতে বন্দিদের প্রতি ৫ মিনিটের কলে ২০০ টাকা করে নিচ্ছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারের টেলিফোন অবৈধভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে ইয়াবা কারবারিদের কাছে।
দৈনিক ৭০/ ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে এ লিজ নিয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট।
সরকারি হিসাবে দৈনিক গড়ে আসামিদের সঙ্গে ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ লোক কথা বলার নিয়ম থাকলেও এ কারাগারে দৈনিক কথা বলেন ১৫শ জন।
এছাড়া নিয়মবহির্ভূত ভাবে চলছে মোবাইল বাণিজ্য। এছাড়া নতুন বন্দিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে।
নতুন যারা কারাগারে ঢোকেন তাদের পছন্দের ওয়ার্ড বা সেলে রেখে জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা আদায় করেন জেল সুপার জেলার এবং সুবেদার সিন্ডিকেট।
জানাগেছে, টাকা না দিলে
কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দীদের ভোগান্তির শেষ থাকে না।
এদিকে আসামিরা সাধারণ ওয়ার্ডের কোথায় থাকবেন, কতটা ভালো থাকবেন, কী খাবার খাবেন-তা নির্ভর করে সিন্ডিকেটের ওপর।
টাকার পরিমাণ বিবেচনায় নতুন আসামিদের সুযোগ-সুবিধা করে দেয়
এ সিন্ডিকেট।
টাকা দিতে রাজি না হলে নতুন বন্দিদের অহেতুক আলাদা করে রাখা হয়
। টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত খাবার ও গোসল ঠিকমতো করতে দেওয়া হয় না।
কারাগারে যেভাবে ঢুকে টাকা : হাজতি বা কয়েদিদের নগদ টাকা প্রয়োজন হলে কারারক্ষীদের মাধ্যমে যত টাকা ইচ্ছা কারাগারে ঢুকানো যায়। এক্ষেত্রে প্রতি হাজারে কারারক্ষীদের কমিশন দিতে হয় ২০০ টাকা।
কারা হাসপাতাল ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে : কক্সবাজার কারাগারে দোতলা একটি হাসপাতাল আছে। সেখানে অসুস্থ কারাবন্দিরা ঠিকমতো চিকিৎসা পান না।
ওষুধ চাইলে পরে দেওয়া হবে, নতুবা নেই বলে খালি হাতে ফেরত পাঠানো হয়। হাসপাতালের ওষুধ বিক্রি ও বন্দিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে ফার্মাসিস্টের বিরুদ্ধে।
অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল বন্দিরা মাসিক ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা করে ফার্মাসিস্টকেে দিয়ে হাসপাতালে আবাসিক হোটেলের মতো বাস করেন। খাবারও খান ভালোমানের। আর প্রকৃতপক্ষে যারা অসুস্থ তাদের হাসপাতালের মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। ইয়াবা ব্যবসায়ী ও বিত্তশালীরা টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতাল তাদের দখলে রেখেছে।
জেলখানার ভেতরে একপাশে তৈরি করা হয়েছে কারা ক্যান্টিন। সেখানে কয়েকশ হাজতি ও কয়েদির পছন্দমতো খাবার রান্না হয়। ক্যান্টিনে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রির নিয়ম থাকলেও ৫-১০ গুণ দাম নেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ৭০০ বন্দির ধারণক্ষমতার কারাগারে বর্তমানে তিন হাজারের বেশি বন্দি থাকেন। বন্দিদের জন্য দৈনিক খাদ্য তালিকা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয় না।
ক্যান্টিন ও ওয়ার্ডে সিট বাণিজ্য :
সদ্য কারামুক্ত একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, কারাগারের সাগর ভবন আমদানি ওয়ার্ড নামে পরিচিত ১নং ওয়ার্ডে ১০০ আসামি থাকেন। সেখানে প্রতিজনের কাছ থেকে মাসে নেওয়া হয় ৩ হাজার টাকা করে। অন্য ভবনগুলোতে প্রতিমাসে দিতে হয় দুই হাজার টাকা করে।
সব ওয়ার্ডে একই অবস্থা। হাসপাতালে সাধারণ বন্দিদের চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে মাসের পর মাস থাকে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। তাদের খাবার ও রান্না করা হয় হাসপাতালের রান্নাঘরে।
অপর একটি সুত্র জানান, ভেতরে থাকা কেন্টিন কারারক্ষীদের ভাড়া দেওয়া হয়। এজন্য প্রতি ২ মাসে ১০ লাখ টাকা ঘুস ছাড়াও মাসে ২৫ লাখ টাকা করে ভাড়া দিতে হয় জেলার এবং সুপারকে।
টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন জেলারের পছন্দের কুমিল্লা সিন্ডিকেট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারের বন্দিদের প্রাপ্য সরকারি বরাদ্দ করা চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগই লুটপাট হয়।
নির্দেশনা অনুসারে প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকালে যে পরিমাণ খাবার পাওয়ার কথা তা কখনোই দেওয়া হয় না বন্দিদের।
জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্তরা জানান, জেল সুপারের
ইচ্ছে অনুযায়ী রান্না হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মাছের মাথা দিয়ে সবজি রান্না, ব্রয়লার মুরগি দিয়ে ডাল এবং দুপুরের সবজির বদলে আলু রান্না করে খাওয়ানো হয়।
আর এসব তরকারি বিতরণের সময় জেল সুপারের সিন্ডিকেটের সদস্যরা উপস্থিত থাকেন। যেন কোনো বন্দি এর প্রতিবাদ করতে না পারেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপরে নেমে আসে নির্যাতন।
অভিযোগের বিষয়ে সুপারের বক্তব্য জানতে ইতিপূর্বে কয়েকবার ফোন করা হলেও জেল সুপার ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।