সাঈদুর রহমান রিমন:
কক্সবাজার সহ দেশের ৯ জেলার ১৬টি পয়েন্ট সাংবাদিকদের জন্য ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে উঠেছে। এসব স্থানে দফায় দফায় সাংবাদিক নীপিড়ন, নির্যাতন, মামলা হয়রানি এমনকি হত্যাকান্ডও ঘটেছে। বিপজ্জনক স্থানসমূহে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, চিহ্নিত অপরাধী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এমনকি বিরোধী দলের নেতা কর্মিরাও সাংবাদিকদের উপর হামলা চালাতে দ্বিধা করছেন না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দলীয় চরম কোন্দলে জর্জরিত নেতারা সাংবাদিকদেরও পক্ষে বিপক্ষে ঠেলে দেন এবং পরস্পর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করেন। সারাদেশেই কমবেশি সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটলেও সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে হুমকিপূর্ণ এলাকাগুলো হচ্ছে, পাবনা, জামালপুর, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ঢাকার সাভার ও ধামরাই, গাজীপুর সদর ও টঙ্গী, নারায়নগঞ্জের সদর, সোনারগাঁও ও রুপগঞ্জ, ঝালকাঠি জেলার সদর ও রাজাপুর। এছাড়া খোদ রাজধানীতেও উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী এলাকা ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণসহ এ প্রতিবেদকের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সাংবাদিক নির্যাতনের অভয়াশ্রম খ্যাত এ জনপদগুলোতে মুক্তবুদ্ধির চর্চার কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। সেখানে আছে সামাজিক বিদ্বেষ, হানাহানি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর দখলবাজ-লুটেরা শ্রেণীর একচ্ছত্র আধিপত্য। পেশাদার অপরাধীরাই দন্ডমুন্ডের কর্তা হওয়ায় সর্বত্র অসম পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে। এ পরিবেশে সকল শ্রেণী পেশার মানুষজন জিম্মিদশায় থাকলেও মাঝে মধ্যে সংবাদকর্মিরা প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক তখনই তাদের উপর নেমে আসে নানা নির্মমতার খড়গ। তবে ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার পেছনেই প্রতিদ্বন্দ্বী সাংবাদিক গ্রুপের নেপথ্য ইন্ধন থাকে। এক্ষেত্রে চিহ্নিত অপরাধী ও দলীয় নেতা কর্মিদের সাংবাদিকতায় অনুপ্রবেশ, অশিক্ষিত শ্রেণীর অপেশাদারিত্ব, অপসাংবাদিকতা, ভূঁইফোড় নানা সংগঠন গড়ে ওঠা, সংবাদের পরিবর্তে টুপাইস কামানোর ধান্ধাবাজিতে বেশি উৎসাহ থাকার কারণেও সাংবাদিকরা হুমকি ও হামলার শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
নির্যাতিত সাংবাদিক ফরিদুলের ৬ মামলা প্রত্যহার হয়নি এখনো :
লেখালেখির কারনে ওসি প্রদীপের হাতে নির্যাতিত ককসবাজারের আলোচিত সাংবাদিক দৈনিক কক্সবাজারবানী ও জনতারবানী সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফা খানের বিরুদ্ধে দায়ের কৃত ৬ মিথ্যা মামলা এখনও প্রত্যাহার হয়নি।
সাজানো মামলায় টানা ১১ মাস ৫ দিন কারাভোগের পর জামিনে এসে প্রদীপ গংয়ের বিরুদ্ধে আদালতে দায়েরকৃত তার ফৌজদারি মামলাটিও আদৌ রেকর্ড হয়নি।
ফলে একদিকে নিজের মিথ্যা মামলা অপরদিকে মামলা – হামলায় জড়িতদের শাস্তি ও ন্যায় বিচারের দাবিতে আদালতে র দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান।
তিনি অভিযোগ করেছেন, মামলাগুলো প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ অনলাইন সংবাদ পত্র সম্পাদক পরিষদ প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছেন দীর্ঘ দিন হচ্ছে।
যার রিসিভ কপি তাদের কাছে আছে।
কিন্তু অদৃশ্য কারনে এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা।
এই অবস্থায় নির্যাতিত সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা নিজের সকল মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহার ও জড়িতদের বিরুদ্ধে তার দায়েরকৃত মামলা আমলে নিয়ে আসামিদের আইনের আওতায় আনতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,বিচার বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের তড়িৎ হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তিনি বলেন,মাদক ও ঘুষের বিরুদ্ধে লিখেছি বলে প্রদীপ ও তার লালিত মাদকব্যাবসায়ায়ীরা পাষবিক নির্যাতন করছে।
৬ টি মিথ্যা মামলা দিয়ে টানা ১১ মাস কারাগারে রেখেছে।
আমি বর্তমানে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক বিপর্যয়ে আছি।
এই মামলা চালাতে পারছিনা আর।
কাজেই এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না হলে বিনা অপরাধে আমার সাজা হবে।
আর তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছি তা রেকর্ড না হওয়া মানে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া।
এতে করে দেশের বিচার ব্যাবস্থা,ন্যায় বিচার ও সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ব হচ্ছে।
অতএব এ ব্যাপারে সকলের আন্তরিক সহায়তা প্রয়োজন।
এদিকে বীনা অপরাধে সাংবাদিক ফরিদুলের দীর্ঘ কারভোগ,শারীরিক নির্যাতন, মামলা প্রত্যাহার না হওয়া ও জড়িতদের আইনের আওতায় না আনা সহ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নজিরবিহীন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশী বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ।
এক বছরেই নির্যাতিত ২৪৭ সাংবাদিক
২০২০ সালে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৪৭ জন সাংবাদিক। আর এতে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর দেওয়া প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘করোনাকালেও মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করে দমন-পীড়ন বেড়েছে। বিশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতার বৃদ্ধি পেয়েছে। আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের তথ্য মতে ২০২০ সালে ১২৯টি ডিজিটাল মামলায় ২৬৮ জনকে আসামি করা হয়। এসব মামলায় সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের আসামি করা হয়।
দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কখনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, কখনোবা প্রশাসন এসবের পেছনে থাকে। কিন্তু এগুলোর বিচার না হওয়ায় দেশে এমন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এরমধ্যে কক্সবাজারের সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান, ময়মনসিংহ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক খায়রুল আলম রফিক, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে সংবাদ এর সাংবাদিক কামাল হোসেনকে গাছে বেধে নির্মম নির্যাতন, বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানোর পর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কারাদন্ড প্রদান, পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলকে রাতের আধারে তুলে নিয়ে চোখ মুখ বেধে ৫৩ দিন অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখা, জামালপুরের সাংবাদিক শেলু আকন্দ’র হাত পা গুড়িয়ে চিরতরে পঙ্গু বানানোর ঘটনা দেশবাসীর হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এসব নিয়ে সাময়িক হৈচৈ হয়, প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ নানা আন্দোলনও হয় কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায় না মোটেও। সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফার নামে মিথ্যা মামলার হয়রানি নিয়ে সাংবাদিক নেতা থেকে শুরু করে এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই আফসোস করেন কিন্তু তার মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তির ব্যবস্থা করে তাকে বেঁচে থাকার উপায় করে দিতে কেউ এগিয়ে আসেন না।
তাছাড়া ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট পাবনায় আনন্দ টিভি’র সাংবাদিক সুবর্ণা নদী, ২০১৯ সালের ২১ মে প্রিয় ডট কমের সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ২০২০ সালেল ১১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে সাংবাদিক ইলিয়াস শেখ (৪৫) কে এবং সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে সাংবাদিক বোরহানকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে চলতি বছরের শুরু থেকেই সাংবাদিক নীপিড়ন নির্যাতনের ঘটনা অসাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সাংবাদিক নেতারা বললেন…
সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে জানাতেই সাংবাদিক নেতা আহমেদ আবু জাফরের নাম বদলে গেছে, তিনি এখন সর্বত্র পরিচিতি পান ‘প্রতিবাদী জাফর’ নামে। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের (বিএমএসএফ) মহাসচিব আহমেদ আবু জাফর বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সাংবাদিক নির্যাতন, হুমকি, মামলা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বহুমুখী ঝুঁকির মধ্যেই দায়িত্ব পালনে বাধ্য হচ্ছেন সাংবাদিকরা। বিএমএসএফ মহাসচিব বলেন, পেশার এই ঝুঁকি রাজধানী ঢাকায় অপেক্ষাকৃত কম হলেও ঢাকার বাইরে তা বহুগুণ বেশি।
হত্যা, হত্যার হুমকি, মানসিক চাপ, শারীরিক আঘাত, হামলা ও মামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের কোথাও কোথাও অপরাধীদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকার কারণেই সাংবাদিকরা হুমকি ও বিপন্নতার মুখে পড়ছেন। সরকার ও প্রশাসনের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে লিখলেও নেমে আসছে নির্যাতন নির্মমতার খড়গ। আহমেদ আবু জাফর বলেন, ‘অপরাধ, দুর্নীতি, জবর দখলের প্রতিবেদন প্রকাশ করার অপরাধে অনেক সাংবাদিককে এলাকাছাড়া হতে হয়েছে। অবস্থা এতই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হুমকিগ্রস্ত সাংবাদিকদের আশ্রয় দিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে শেল্টার হোম খোলার উদ্যোগ পর্যন্ত নিতে হয়েছে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট স্থানীয় আওয়ামীলীগের দু’ গ্রুপের সংঘর্ষকালে অস্ত্র ব্যবহারের ভিডিওধারণ করছিল মুজাক্কির। ক্ষিপ্ত হয়ে একটি পক্ষের সন্ত্রাসীরা তাকে ধরে নিয়ে ভিডিও ডিলেট করতে চাপ প্রয়োগ করে। ভিডিও ডিলেটে অসম্মতি জানালে তাকে লক্ষ্য করে উপুর্যপরি গুলি করা হয়। তিনদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। সম্প্রতি সংবাদের জের ধরে গাজীপুরে সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিককে পিটিয়ে হাতপা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে কামাল হোসেনকে বালু-পাথর খেকো সন্ত্রাসিরা গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন চালানোর ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাও হার মানিয়েছে।
চলমান সাংবাদিক নির্যাতন নিয়ে এ প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মিজান মালিক বলেন, আমি মনে করি তথ্য প্রযুক্তি আইনে সংস্কার আনা দরকার। নির্যাতন কেবল শারীরিকভাবে হতে হবে এমনটি নয়। আইনী বেড়ি দিয়ে, নিপীড়ন করে বা মামলা দিয়ে হয়রানি করাও এক ধরনের নির্যাতন। এটা সব সময় উদ্দেশ্য প্রনোদিত নাও হতে পারে। পরিস্থিতিও হয়ে যায়। আর এর জন্য দায়িত্বে নিয়োাজিতরাও ক্রেডিট নিতে গিয়ে অনেক সময় বাড়াবাড়ি করেন। হয়তো তাকে কেউ এমনটি করতে বলেননিও।’ আরেকটা বিষয়, আমাদের নিজেদেরও সতর্ক থাকতে হবে। যাতে করে কোনো রিপোর্টের জন্য অকারণে হয়রানির শিকার হতে না হয়। তবে এটাও ঠিক, অপরাধী বা দুর্নীতিবাজরা এখন বেশ বেপরোয়া। তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট হলেই মামলার হুমকি, হত্যার হুমকি আসে। এটা হয়েছে জবাবদিহিতার ঘাটতি থেকে। সে মনে করে কে তাকে প্রশ্ন করবে, কে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে! এই জায়গায় সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে, আমি মনে করি, আমাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে। সাংবাদিক নিপীড়ন বা নির্যাতনের ঘটনায় সবাইকে এক সুরে প্রতিবাদ করতে হবে। না হলে সাগর রুনি হত্যার তদন্তের মতো স্পর্শকাতর ঘটনাও একদিন চাপা পড়ে যাবে। সাংবাদিকরা যতদিন ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার ছিলেন, সাগর রুনি হত্যাকান্ডের তদন্তও গতির মধ্যে ছিল। এখন কেবল তারিখ পড়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের। দাখিল আর হয় না।
সাংবাদিক নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে হাতে গোণা কয়েকটি ঘটনায় বাদ, প্রতিবাদ, মিছিল, মানববন্ধনের ঘটনা ঘটলেও বেশিরভাগ নির্যাতনের ঘটনা চাপা পড়ে থাকে। অনেক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দায়সারা গোছের একটি প্রতিবাদ বিবৃতি পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়। আবার এক সাংবাদিক সংগঠনের সদস্য হামলার শিকার হলে অন্য সাংবাদিক সংগঠন নির্যাতিত সাংবাদিককেই চাঁদাবাজ, ভূয়া সাংবাদিক আখ্যা দিয়ে রীতিমত নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ঘৃণ্য নজিরও রয়েছে।
বিচারহীনতায় বেড়েই চলে বর্বরতা
সাংবাদিকদের উপর সংঘটিত নীপিড়ন নির্যাতনের কোনো কোনো ঘটনা শুনলেই গা শিউরে উঠে। কারো কারো হাত পা গুড়িয়ে দেয়ার বর্বরতায় কেউ চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সাংবাদিক নির্যাতনের সেসব ঘটনায় এমনকি সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। ফলে সাংবাদিকদের উপর হামলা, নির্যাতন, বর্বরতার ঘটনা মোটেও কমেনি, বরং দিন দিনই তা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়েই চলেছে। সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর রুনির নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে গত নয়টি বছর ধরে সাংবাদিকরা রাজপথে আন্দোলন করছে, বাদ-প্রতিবাদ, মানববন্ধন বহু হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি, খুনিদের চিহ্নিত পর্যন্ত করা যায়নি। তারচেয়েও পুরনো ঘটনা ঘটেছে রাঙ্গামাটিতে। ২০০৭ সালের ৫ মার্চ নিখোঁজ হন রাঙামাটির সাংবাদিক মো. জামাল উদ্দিন। পরদিন রাঙ্গামাটি পর্যটন এলাকার হেডম্যান পাড়ার বন থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর থেকে বিগত ১৪ বছর ধরেই তার অপহরণ ও হত্যার বিচার চেয়ে মাসববন্ধন, স্মারকলিপি পেশসহ নানা আন্দোলন চলছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, বের করা যাচ্ছে না জামাল উদ্দিনের খুনিদেরও।
সাম্প্রতিক সময়েও দুটি নির্মম ঘটনা সাংবাদিকদের তটস্থ করে তুলেছে। দুটি ঘটনায় শিকার সাংবাদিক খুন হননি বটে তাদের গোটা পরিবারকেই হত্যার মতোই নির্লিপ্ত করে দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ১০ মার্চ নিখোঁজ হয়েছিলেন কাজল। ৫৩ দিন পর বেনাপোল সীমান্তের কাছে থেকে তাকে ‘আটকে’র তথ্য জানায় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। মামলা তিনটি দায়ের করেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর এবং যুব মহিলা লীগের দুইজন নেতা। এরপর সাত মাস ধরে বারবার জামিনের আবেদন করা হলেও তা নাকচ করে দেয় নিম্ন আদালত। শেষ পর্যন্ত গত ২৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে তিনটি মামলায় জামিন পান তিনি। অজ্ঞাত অপহরণকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পরই গণমাধ্যমকে শফিকুল ইসলাম কাজল বলেছেন, বেনাপোলে ছেড়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত ৫৩ দিন আমার চোখ বাঁধা ছিল, মুখ আটকানো ছিল আর হাতে ছিল হ্যান্ডকাফ। মনে হচ্ছিল যেন একটি কবরের ভেতরে আছি, খুব ছোট একটা জায়গা, একটা জানালা পর্যন্ত ছিল না। আমি শুধু মৃত্যুর প্রহর গুণতাম। সেই অবস্থাটা বর্ণনা করার মতো না। আমি আমার পরিবারের কথা চিন্তা করে সময় কাটিয়েছি। খালি মনে হতো ওদের আর দেখতে পাবো না। মনে হচ্ছিল মারা গেছি আর কোনোদিন ফিরতে পারবো না।” কিন্তু কারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কেন বা কোথায় তাকে আটকে রেখেছিল, তা তিনি প্রকাশ করতে চাননি। জানাতে চাননি তার অপহরণকারীরা কী চেয়েছিল বা কিসের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দিয়েছে।
চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন শেলু আকন্দ
জামালপুরের সাহসী সাংবাদিক শেলু আকন্দ। সন্ত্রাসি চক্রের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দেয়ায় অপরাধে (!) চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে তাকে। কী অপরাধ ছিলো শেলুর? একজন সাংবাদিককে নির্মম ভাবে মারপিটের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি, সাক্ষী হয়েছিলেন মারপিট মামলায়। এই অপরাধে রাতের অন্ধকারে একদল সন্ত্রাসী তার উপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। লোহার রড়, জিআই পাইপ দিয়ে তার দুটি পা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে তার লাশ নদীতে ফেলে দিতে উদ্যত হয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় এক নারীর চিৎকারে শেলু আকন্দ’র নিথর দেহটা নদী তীরে ফেলেই পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। মৃত্যুর মুখোমুখি শেলু তখনও বেঁচে ছিলেন। খবর পেয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে শেলুকে উদ্ধার করে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। পঙ্গুতে টানা ২ মাস চিকিৎসার পর এখন ঢাকাতেই মেয়ের বাসায় বিছানা আর জানালাকে সঙ্গী করে তাকিয়ে তাকিয়ে রাত দিন পার করছেন তিনি।