নিজস্ব প্রতিবেক:
মন্ত্রী পরিষদের সাবেক সচিব নুরুল আলমের গুনধর ভাইয়ের সন্তান কক্সবাজারের উখিয়ার রুমখাপালং মাতব্বর পাড়া এলাকার একজন সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি সৌদি আরবে থাকাকালীন পেশায় ছিলেন রংমিস্ত্রি।
তার আগে জেলা পরিষদের যাত্রী ছাউনির এক পাশে বসে ফ্লাক্সিলোডের ব্যবসাও করতেন। ২০১৮ সালে সৌদি থেকে দেশে ফিরে বিয়ে করেন এক চেয়ারম্যানের মেয়েকে।
২০১৯ সালে ২৫ মার্চ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। এরপরই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে জাহাঙ্গীর আলমের। নির্বাচনি ইশতেহার মাত্র ১২ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দেখানো হলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি এখন ২৬৫ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
এলাকায় অভিযোগ আছে, মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা, স্বর্ণ চোরাচালান ও রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশ পাঠিয়ে তিনি এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন। কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। নামে-বেনামে এসব সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জাহাঙ্গীর আলমের এত অর্থ-সম্পদের অনুসন্ধান চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), নির্বাচন কমিশনসহ ১৮টি স্থানে অভিযোগ করেছেন জসীম উদ্দিন আজাদ নামে এক ব্যক্তি। স্থানীয় সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই সরওয়ার আলম একসময় লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করতেন। জাহাঙ্গীর ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ার পর সরওয়ারকে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। জাহাঙ্গীর তার চাচাতো ভাই সরওয়ার বডিগার্ড রুমখাঁ কোলালপাড়ার সোনা আলীর ছেলে সেলিম উল্লাহকে দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। এক বছরের মধ্যে তিনি ইয়াবার বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ইয়াবা ব্যবসার পাশাপাশি নাইক্ষ্যংছড়ির সোনাইছড়ি দিয়ে মিয়ানমার থেকে স্বর্ণ চোরাচালান শুরু করেন। ইয়াবা ও স্বর্ণের চোরাচালানের মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। তবে প্রভাবশালী হওয়ায় জাহাঙ্গীর আলমের সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাদকসহ একাধিকবার গ্রেফতার হলেও তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা হয়নি।
জসীম উদ্দিন সময়ের আলোকে জানান, উখিয়া উপজেলা পরিষদের পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের বাবার নাম মো. নুরুল আলম। উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের রুমখাপালং মাতব্বর পাড়ার ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী থাকলেও ২০০৩ সাল পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন তিনি। ২০০৪ সালে যান সৌদি আরবে। সেখানে রংমিস্ত্রির কাজ করতেন। ২০১৬ সালে তার প্রভাবশালী আত্মীয় সৌদি আরবে গেলে সেখানকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর থেকেই তিনি সেখানে থেকে দেশে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরি করে সৌদি আরবে শরণার্থীদের রিসিভড করেন তিনি। বিনিময়ে বাগিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। একই সঙ্গে স্থানীয়দেরও বিদেশে পাঠিয়েছেন তিনি। আদম ব্যবসার সিন্ডিকেট তৈরি করে ২০১৮ সালে দেশে আসেন তিনি। এরপর ২০১৯ সালে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপরই শত শত কোটি টাকার সম্পদ ও অর্থ বানান বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওই সূত্র জানায়, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের ভাই কলেজপড়ুয়া মামুনের নামেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ রয়েছে। মামুন ছাত্রাবস্থায় এত অর্থের মালিক বনে যাওয়ায় এলাকাবাসীর মনে প্রশ্ন উঠেছে।
জসীম উদ্দিন আজাদ তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ২৫ মার্চের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনের সময় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম তার নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা ও সম্পদের বিবরণে উল্লেখ করেন তার মোট সম্পদ ১২ লাখ টাকার। এর মধ্যে রয়েছে তার ব্যবসায় মূলধন ৫ লাখ টাকা, নগদ ২ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ১ লাখ টাকা ছাড়াও ২ লাখ টাকা মূল্যের বিয়ের উপহারের স্বর্ণ এবং ২ লাখ টাকার আসবাপত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী।
অভিযোগে বলা হয়, হলফনামায় তার কোনো স্থাবর সম্পদ জমি বা ঘর, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও গাড়ি কিছুই ছিল না। ভাইস চেয়ারম্যানের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকলেও এখন তার রয়েছে দুটি বিশাল বাড়ি, কক্সবাজারে হোটেল, চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকায় দামি ফ্ল্যাট, প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাক সবই আছে তার। এই ভাইস চেয়ারম্যানের বর্তমান অর্জিত সম্পদ হলো উখিয়া উপজেলা রুমখাঁ বাজার এলাকায় ২৯৪০ খতিয়ানে নিজের ও কলেজপড়ুয়া ভাই মামুনের নামে কোটি টাকা মূল্যের ১৭ শতকের একটি জমি ক্রয় করে, সে স্থানে ৩ কোটি টাকা খরচ করে একটি বহুতল ভবন বানিয়েছেন। ওই ভবনে গত তিন বছর ধরে জাহাঙ্গীর নিজে বসবাস করে আসছেন।
উখিয়া উপজেলার ব্যয়বহুল কোটবাজার এলাকায় রত্নাপালং মৌজায় ৩৭৬৮ খতিয়ানে ৬৫ শতক জমি ক্রয় করেন যার বর্তমান বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকার ওপরে (খতিয়ান সংযুক্ত)।
ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কোটবাজার স্টেশনে একই মৌজায় ৫৩২৩ খতিয়ানে ১৬ শতক জমি ক্রয় করে একটি বহুতল অত্যাধুনিক ভবন তৈরি করেছেন জমিসহ যার বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও উখিয়ার কোটবাজার স্টেশনে রত্নাপালং মৌজায় প্রণব রায় চৌধুরীর কাছ থেকে তিনি একসঙ্গে ২ একরের বেশি জমি ক্রয় করেন যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৫ কোটি টাকারও বেশি।
২০১৯ সালে কক্সবাজার শহরের কলাতলির সৈকতের লাগোয়া ঝিলংজা মৌজায় যৌথভাবে তিনি একটি জমির মালিক যার বর্তমান বাজারমূল্য ৮ কোটি টাকা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, উখিয়া উপজেলার ইনানী মৌজায় মেরিন ড্রাইভ রোডের হ্যাচারি জোন, ইনানী ও মনখালী এলাকায় ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর, তার শ্যালক শাহা আমিন ও বন্ধু জসিম উদ্দিনের নামে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের জমি রয়েছে। এ ছাড়াও চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকায় নিজ নামে, পিতার নামে ও ভাইয়ের নামে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
গত কয়েক বছরে ভাইস চেয়ারম্যান তার স্বজনদের নামে কক্সবাজারের কলাতলিতে ২টি হোটেল যার আনুমানিক মূল্য ৬০ কোটি টাকা। পাশাপাশি কক্সবাজার থেকে উখিয়া রোডে পালং স্পেশাল সার্ভিসের সভাপতিও তিনি। তার ১০টি বাস যার বাজারমূল্য ২ কোটি টাকা। এ ছাড়াও তার চারটি ট্রাক আছে যার বাজার মূল্য ৫০ লাখ টাকা।
অভিযোগকারী অভিযোগ করেন, উখিয়ার রত্নাপালং, রুমখাপালং ও জালিয়াপালং মৌজা, রামুর উপজেলার খুনিয়াপালং, হিমছড়ি, পেঁচারদ্বীপ মৌজা এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় নিজের নামে, স্ত্রীর নামে এবং শ্যালকের নামে আরও প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। যার সবকিছুই অবৈধ উপায়ের মাধ্যমে গত সাড়ে চার বছরে তিনি অর্জন করেন।
ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর ও তার চাচার যৌথ মালিকানাধীন কোটবাজার স্টেশনে রয়েছে একটি গ্যাস পাম্প যার বাজারমূল্য ২ কোটি টাকা। সৌদি প্রবাসী একজন রংমিস্ত্রি ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ১২ লাখ টাকার সম্পদ থেকে এখন প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়ায় হতভম্ব খোদ এলাকাবাসী। অভিযোগে আরও বলা হয়, এসব স্থাবর সম্পদ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে নিজের নামে, স্ত্রী ও দুই শ্যালকের নামে অঢেল অর্থ জমা আছে।
কক্সবাজারের সদর, রামু ও উখিয়া সাব রেজিস্ট্রার অফিসের পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়ও তার অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া যাবে বলে তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন।
তবে অভিযুক্ত ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম সময়ের আলোকে বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার পরিবারের মধ্যে ১৭ জন চেয়ারম্যান রয়েছে। চাচা সরকারের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তার সবই মিথ্যা। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর সাড়ে চার হাজার টাকার সম্পদও আমি বানাইনি। তবে বিদেশে লোক পাঠানোর কথা স্বীকার করেন তিনি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জানান, তার ও তার ভাইয়ের নামে যে সম্পদ রয়েছে তার সবই গড়েছেন বিদেশ থাকাকালীন।
নির্বাচনি ইশতেহারে ১২ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য উল্লেখ করার কথা বলা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে মামলা চলমান রয়েছে।