ফরিদুল মোস্তফা খান :
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডের পর আলোচনায় আসে ওসি প্রদীপ দাশের অন্ধকার জগতের তথ্য।
ক্রসফায়ার ‘বাণিজ্য’ ও মাদক ব্যবসায় মদত দেয়ার মাধ্যমে টাকা কামানোর নেশায় পরিণত হয়েছিল প্রদীপের।
কিন্তু তিনি কী একাই এই কাজ করেছেন? না। তার সঙ্গে ছিলেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনও।
গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের ভাষ্যে উঠে আসা কক্সবাজারের সেই সাবেক এসপি মাসুদ হোসেনকে পদোন্নতি দিয়ে এ্যাডিশনাল ডিআইজি করেছে সরকার।
ফলে নিজেদের প্রিয় পুলিশ কর্মকর্তার পদোন্নতিতে কক্সবাজারে মাদক সিন্ডিকেটে বিরাজ করছে উল্লাস।
সামাজুক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইনে-তারা পদোন্নতি প্রাপ্ত এ্যাডিশনাল ডিআইজি মাসুদ হোসেনকে আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
এদের কেউ কেউ গুণধর উক্ত পুলিশ কর্মকর্তার সাথে তুলা ছবি পেইজবুকে আপলোড দিয়ে জানান দিচ্ছেন, আমরা এ্যাডিশনাল ডিআইজি মাসুদ সাহেবের ঘনিষ্ঠ জন।
জানা গেছে, কক্সবাজারে কর্মরত থাকা কালীন এই এসপি মাসুদের আশকারায় নির্যাতিত সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানকে ৬ টি সাজানো মামলা দিয়ে ক্ষান্ত হননি।তারা সাংবাদিক ফরিদুলকে পাশবিক নির্যাতন করে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা চেষ্টার পাশাপাশি ওসি প্রদীপসহ একাধিক সদস্য বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন দিনের পর দিন।
কক্সবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে দুর্নীতি, টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেয়া, বড় মাদক ব্যবসায়ীদের না ধরে চুনোপুঁটিদের ধরা,আত্নসমর্পণকৃত সেই ১০২ ইয়াবা গডফাদার থেকে উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে গোপন মাসোহারা, ক্রসফায়ার বাণিজ্য, অভিজাত হোটেল থেকে চাঁদা আদায় ও সংশ্লিষ্ট জেলার জামায়াত নেতাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন উঠছে, সিনহা হত্যাকাণ্ডে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের ভূমিকা নিয়েও।
ওসি প্রদীপ বা লিয়াকতের মতো কয়েকজনের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগ এলেও তাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জেলা পুলিশ।
অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ থাকতো কক্সবাজারের এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি করার মাঝেই।
তাদের কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সায় ছিল তৎকালীন সেই এসপি মাসুদ।
সুত্র জানায়,মাসুদের স্ত্রী জেনিফার মুনের নামে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়া ছাড়াও নামে-বেনামে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে।
বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জের দক্ষিণ ওলানিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের আব্দুল কাদের হাওলাদার ও অজুফা খাতুনের ছেলে এবিএম মাসুদ হোসেন ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
শিবিরের একজন নেতার মাধ্যমে তিনি ইসলামী ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলেন বলে তথ্য রয়েছে।
জোট সরকারের আমলে ২৪তম বিসিএসে এএসপি হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শ্বশুরের পরিচয়ে তিনি সুবিধা নেন বলে গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য পেয়েছে।
সূত্র মতে, ইয়াবার নামে হয়রানি, মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায় নইলে ক্রসফায়ারে দেয়াসহ নানা অভিযোগ এসেছে তার বিরুদ্ধে।
কথিত আছে-উড়ন্ত ইয়াবা ডন হিসেবে চিহ্নিত ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে কোটি টাকার বিনিময়ে আত্মসমর্পণের নামে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার ছত্রছায়ায়।
অন্যদিকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে মাদক বহনকারী চুনোপুঁটিদের। এই কারণে এখনও ইয়াবার রাজ্য কক্সবাজারে যেমন ছিল ঠিক তেমনই রয়েগেছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজারে প্রায় ৩০০টি অভিজাত হোটেল রয়েছে।
এইসব হোটেল থেকে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
যদি কোনো হোটেল মালিক ওই টাকা দিতে রাজি না হন তাহলে ওই হোটেলে অবৈধ কারবার হয়- এমন মিথ্যা দাবি দিয়ে বন্ধের হুমকি দেয়া হত।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, কক্সবাজার এলাকায় মাদকের যেসব ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়েছে তার অধিকাংশই খুচরা ব্যবসায়ী।
যারা ইয়াবার কারবার করে শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন, গড়েছেন বড় বড় রাজকীয় অট্টালিকা তারা থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অপারেশন শুরু হওয়ার আগেই তাদের পুলিশের পক্ষ থেকে সংকেত দেয়া হত বলে সূত্রের দাবি।
সরকারি সংস্থার তদন্ত সূত্র বলেছে, মহেশখালীর ৬৮ জন জলদস্যুর আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিলের ওসি প্রদীপ।
এ ঘটনায় প্রদীপকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ থাকলেও ১৫ দিনের মাথায় প্রদীপকে টেকনাফের ওসির দায়িত্ব দেন এসপি মাসুদ।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে গত ৩১শে জুলাই টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের চেকপোস্টে গুলি করে হত্যা করেন এসআই লিয়াকত। ঘটনার পরই লিয়াকত ও ওসি প্রদীপ এসপি মাসুদের সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বলেন। এ নিয়ে ওসি প্রদীপও কথা বলেন পুলিশ সুপারের সঙ্গে। তাদের কথোপকথনের অডিও প্রকাশ্যে আসায় এসপির ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়।
সেই সময় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ এবং পুলিশ বাহিনির ভাবমূর্তি নিয়ে দেশবিদেশে সীমাহীন সমালোচনার ঝড় উঠায়,কর্তৃপক্ষ তাকে কক্সবাজার থেকে বদলি করে রাজশাহী পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়ন করেন।
এর আগে জব্দ করা হয়েছিল তার ব্যাংক একাউন্ট।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কক্সবাজারে মাদক ব্যবসায়ীদের অভিবাক খ্যাত উক্ত সাবেক এসপি মাসুদ হোসেন অনেকটা ভোল্ট পাল্টিয়ে রাজশাহী পুলিশ সুপার থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর গোয়েন্দা শাখার দায়িত্ব পান।
সর্বশেষ,কয়েকদিন আগে পুলিশের পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মকার্তাদের তালিকায় তাকে এ্যাডিশনাল ডিআইজি করার সংবাদ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজারের সুশীল সমাজ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।