ফরিদুল মোস্তফা খান
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির উত্থান দেড় যুগ আগে হলেও আলোচনায় উঠে এসেছেন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে।
এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেন সরকারি দলের এ সংসদ সদস্য (এমপি)।
নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিশেষ করে ইয়াবা পাচারের ‘গডফাদার’ হিসেবে এমপি বদির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
সর্বশেষ সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে আবদুর রহমান বদিকে ৩ বছর কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত।
এ ঘটনায় আবার নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি।
ওইদিন দুপুরে কক্সবাজারের রাস্তা অবরোধ করে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে তার উগ্র সমর্থকরা। প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী এই অবরোধে চরম ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি হিসেবে আবদুর রহমান বদি সরকারি সুযোগ-সুবিধায় দাপিয়ে বেড়ান দেশ-বিদেশে।
সভা-সেমিনারে দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে রাখেন ‘উগ্র এবং শিষ্টাচার বর্জিত’ বক্তব্য। শাসকদলীয় এমপি বদির এটি প্রকাশ্য জগৎ হলেও তার বিপরীতে রয়েছে বিশাল এক অন্ধকার জগৎ। বাংলাদেশের ইয়াবা ব্যবসার সর্বোচ্চ গডফাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেই জগতের এ মুকুটহীন সম্রাট।
তার ভয়ংকর ছোবলে বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষপ্রান্তের সাগর-পাহাড়-বনভূমিঘেরা টেকনাফ কক্সবাজার এখনও বিষে জর্জরিত।
সুন্দর এ জনপদগুলো হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া এবং পতিতা লম্পটদের অবাধ বিচরণ ভূমি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিদের সঙ্গেও গড়ে তোলেন তিনি গভীর সখ্যতা।
দক্ষিণ এশিয়ার মাদক সাম্রাজ্যে এমপি বদি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। এই জগতে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে মেঝভাই হিসেবে পরিচিত।
চোরাচালান, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল,বেদখল,সংখ্যালগুদের মন্দিরে মুর্তি ভাঙ্গার গোপন নির্দেশনা,অপরাধীদের আশ্রয় পশ্রয়,নিজস্ব প্রেসক্লাব,ইয়াবা সাংবাদিক লালন,নাফ টিভি,এই ডটকম, সেই ডটকম প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নজিরবিহীন সব কর্মকাণ্ডে তার অন্ধকার জগৎকে সমৃদ্ধি এখনও বহাল রয়েছে।
জানা গেছে,এমপি বদি এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে, তার কথামতো কাজ না করায় তিনি নিজেই মারধর করেছেন নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, পুলিশ, নিজ দলের রাজনৈতিক নেতা,বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেককেই। স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, মাদক ও চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতে এমপি বদি গড়ে তোলেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্দর ও ঘাট।
বদির উত্থান :
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত অথবা আওয়ামী লীগ- যে আমলেই হোক, যেভাবেই হোক সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন আবদুর রহমান বদি। বিএনপির কাছে মনোনয়নও চেয়েছিলেন তিনি। তবে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়েই পার হয়েছেন বৈতরণী। এরশাদ সরকারের সময় বদির বাবা এজাহার মিয়া ছিলেন টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান। বাবার কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি সমালোচিত এ এমপির। পরে বদির বাবা যোগ দেন বিএনপিতে।
টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাবার হাত ধরেই টেকনাফ উপজেলা বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন তিনি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিএনপি আমলে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে বিভিন্ন চোরাচালানি ব্যবসায় হাত পাকান বদি।
তবে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তেই বিএনপি থেকে মনোনয়ন চেয়ে বসেন তিনি। সে সময় তিনি মনোনয়নও পেয়ে যান। পরে বিএনপির হাইকমান্ড বদির মনোনয়ন বাতিল করে শাহজাহান চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়। বিএনপির মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
মাদকের রাজধানী টেকনাফ :
স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি বদির কারণে টেকনাফ হয়ে ওঠে মাদকের রাজধানী। ইয়াবার জোয়ারে ভাসে গোটা টেকনাফ কক্সবাজার ।
এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান ব্যবসা হয়ে ওঠে ইয়াবা।সেখানকার অনেক ধর্মান্ধরা ইয়াবা ব্যাবসাকে মনে করেন হালাল। তাদের কেউ কেউ বড় বড় দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে এখনও আসীন থেকে এখনও সরকার বিরোধী নানা কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
টেকনাফের রাজনীতি আর অর্থনীতি- সব ইয়াবাকে কেন্দ্র করেই চলে। এক শ্রেনীর বিপদগামী জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই যে যাদের ইয়াবা ব্যবসায়ে জড়িত করেননি বদি,তার ভাই শুক্কুর সিআইপি শ্যালক উখিয়ার জাহাঙ্গীর সিন্ডিকেট।
ইয়াবাকে বদি এতটাই লাভজনক ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, লবণ চাষ, মাছ চাষ, কাঠ ব্যবসাসহ বিভিন্ন বৈধ ব্যবসা ছেড়ে শত শত ব্যবসায়ী ইয়াবায় অর্থ লগ্নি করছেন।
আর এসব কারণে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা টেকনাফ হয়ে উঠেছে মাদকের স্বর্গরাজ্য। মাফিয়াদের বিচরণে মুখর থাকে সুন্দরের লীলাভূমি এ টেকনাফ।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এমপির সঙ্গে সব সময় চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চলাফেরা। এমপির ভাই, বন্ধু ও সহযোগীরা বেপরোয়া ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি এমপির ক্ষমতার জোরেই চলছে, এ কথা সবাই জানে।
এমপির এই ইয়াবা ব্যবসার কথা জানে সরকার ও দল। এরপরও তারা কিছু করছে না। এমপি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। মাঝে-মধ্যে পুলিশ লোকদেখানো অভিযান চালায়। ক্রসফায়ার হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা সব সময় থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।বন্দুক যোদ্ধে মরে তারা যাকে দেখায় দেয় সে।মামলার আসামি হয় বদি এন্ট্রিরা।বছরের পর বছর জেল খাটে তারা।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বদি ও তার ঘনিষ্ঠরা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট ’ হলেও তারা সব সময়ই থাকে প্রশাসনের নাকের ডগায় এবং ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
বারবার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এলেও তারা প্রকাশ্যেই ইয়াবার রাজ্যে দাপিয়ে বেড়ান বদি সিন্ডিকেট।
ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এতটাই প্রভাবশালী যে, জেলা-উপজেলা আইনশৃংখলা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি তোলার কেউ সাহস করেন না। যদি কেউ বিষয়টি তোলেন, সেক্ষেত্রে এমপি বদি এবং তার মাদক জনপ্রতিনিধি উল্টো তাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ইয়াবার চালানও ছাড়িয়ে নিয়ে যান এমপি বদি। ইয়াবা পাচারে কখনো কখনো বদির গাড়িও ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রমতে, শুধু তাই নয়, এমপি বদি ও তার স্ত্রীর গাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। সর্বশেষ কুমিল্লায় বদির উপস্থিতিতেই আইনশৃংখলা বাহিনী তার গাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা পায়। কিন্তু বিতর্কিত এ সংসদ সদস্য প্রভাব খাটিয়ে পুরো ইয়াবার চালান নিয়ে বীর দর্পে ঢাকায় ফিরেন।
তিনি ব্যাক্তিগতভাবে হেলিকপ্টার ভাড়া করে ইয়াবা পরিবহন করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমাবেশে উপস্থিতির গাড়ি বহরে মাদকের চালান বহন করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃংখলা বাহিনীর এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা দেশের ৩১ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ভাই-বেয়াই, মামা-ভাগ্নে মিলিয়ে বদিসহ ১০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে।
ইয়াবা গডফাদার :
দেশে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত মাদক ইয়াবার নাম উঠলেই এমপি বদির প্রসঙ্গ উঠে আসে। জনশ্রুতি আর অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকারের শুরুতেই এমপি বদি তার লোকজন দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে পাচার শুরু করেন। সেই থেকে পুরো বাংলাদেশ ইয়াবায় সয়লাব হয়ে যায়। তিনি আড়ালে থেকে তার ভাই, বোন, ভাগিনা, বেয়াই ও কর্মীদের দিয়ে ইয়াবা পাচার চালিয়ে আসেন।
বদি গডফাদার হিসেবে অন্তরালে থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা পাচারকারীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে বদির ভাই মো. আবদুল শুক্কর ও মৌলভী মুজিবুর রহমান, দুই সৎভাই আবদুল আমিন ও ফয়সাল রহমানের নাম। এ চার ভাইকে দিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন আবদুর রহমান বদি। চার ভাই ছাড়াও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল এমপি বদির সাবেক স্ত্রী সাবেকুন্নাহার সাকী, বেয়াই আখতার কামাল, শাহেদ কামাল, মামা হায়দার আলী ও মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল, নিকট আত্মীয় টেকনাফ পৌর আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক বাহাদুর, টেকনাফ উপজেলা প্রেসক্লাবের কথিত সভাপতি নুর হোসেন প্রকাশ পুলিশের দালাল বাটপার নুরু, স্থানীয় কথিত সাংবাদিক পরিচয়ী ইমন উদ্দিন,ফরিদ বাবুল সহ অনেকেই।
এমন অভিযোগ তার এলাকার লোকজনের। এছাড়া পারিবারিক এ মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেছেন বোনের ছেলে নীপুকে। এদের সবাই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকলেও কয়েক বছর আগে এক ১২ আগসট চকরিয়া থানা পুলিশের হাতে আটক হন স্ত্রী সাবেকুন্নাহার সাকী। কিন্তু পরে প্রভাব খাটিয়ে বিনা ওজরে ছাড়া পান সাকীসহ সঙ্গে আটক অন্যজন।
সন্ত্রাস ও দখলবাজি :
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ স্থলবন্দর, হাট-বাজার, ঠিকাদারি, পরিবহন, পর্যটকবাহী জাহাজ, টার্মিনাল, জেটিসহ সীমান্ত চোরাচালান ব্যবসা পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন এমপি বদি।
সঙ্গে রয়েছেন তার ছোট ভাই আবদুল আমিন। এখনও আবদুল আমিনের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকনাফ বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। এমপির নিজস্ব বন্দর বলে খ্যাত অবৈধ কাইয়ুকখালী ঘাটের চিংড়ি মাছ, কাঠ, ফলমূল আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেন তার আরেক ভগ্নিপতি গিয়াস উদ্দীন ও ফুফাতো ভাই সৈয়দ আলম। এমপি তার প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমার থেকে আনা মালামাল অবৈধভাবে এ ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। এ বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ চোরাইপণ্য মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
স্থলবন্দর, কাইয়ুকখালী ঘাটসহ সীমান্তের যে কোনো স্থান দিয়েই কোনো মালামাল দেশে ঢুকলে তার গ্র“পের নির্ধারণ করে দেয়া ‘টোল’ পরিশোধ করতে হয়।
মারধরে পারদর্শী : ‘
অবাধ্যতার দায়ে’ বিভিন্ন সময় এমপি বদি নিজেই মারধর করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের একমাত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিন পর টেকনাফ উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোট কেন্দ্রে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে মারধর করেন বদি।
এরপর তার হাতে প্রহৃত হন টেকনাফের বন বিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান। এরপর মার খেয়েছেন শ্যামলাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাতীয় পার্টির নেতা মাস্টার আবুল মঞ্জুর। এছাড়া তার হাতে মার খেয়েছেন কক্সবাজারের বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাখাল মিত্র, শিক্ষক আবদুল জলিল ও পুলিন চন্দ্র, বিজিবির এক ঠিকাদার, জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী আবদুল হালিম, উখিয়ার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা গোলামুর রহমান, কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এক পুলিশ, হোয়াইক্যং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৩নং ওয়ার্ডের কর্মী জসিম উদ্দিনসহ নাম না জানা আরও অনেকে।
তার ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে কক্সবাজারের সাবেক পুলিশ সুপার বর্তমানে পদোন্নতি প্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি (এবিএম) মাসুদ হোসেনের আমলে ওসি প্রদীপ কর্তৃক রাজধানী ঢাকা থেকে বিনা ওয়ারেন্টে ধরে এনে অস্ত্র মাদক চাঁদাবাজির ৬টি মিথ্যা মামলা এবং নির্মম নির্যাতন করে কারাগারের ভেতরে ও বাইরে নিজের লালিত ১০২ মাদক সম্রাট দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল দৈনিক কক্সবাজারবাণীর সম্পাদক ও প্রকাশক নির্যাতিত সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানকে।
এর আগে বদির লালিত সন্ত্রাসীরা নাফ নদী থেকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল কক্সবাজার জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জনকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার এইচএম এরশাদকে।
চরম সাংবাদিক বিদ্ধেষী বদির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে আসে প্রতিবেদকের তদন্তে।
সর্বশেষ এমপি বদির হিংস্রতার শিকার হন নিজ দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি।
২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বদির অনুরোধে সাড়া না দেয়ায় বীর বাহাদুরকে লাঞ্ছিত হতে হয়। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে টেকনাফ পৌরসভার মেয়র থাকাকালে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। তবে এমপি হওয়ার পরে হয়ে ওঠেন হিংস্র।
২০১১ সালের ২৯ জানুয়ারি টেকনাফ পৌরসভা নির্বাচনে চাচা মো. ইসলামের জন্য ভোট কারচুপিতে বাধা দেয়ায় এমপি বদির মারধরের শিকার হন নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা যা বললেন : এমপি বদি ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ থাকায় বিব্রত স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আদিল উদ্দীন চৌধুরীএক সময় বলেছিলেন, এমপির সঙ্গে সবসময় চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চলাফেরা। তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে এমপি চাল, কম্বল এসব বিতরণ করে জনপ্রিয় হতে চান।
মৃত্যুর আগে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সেই সময়ের সাধারণ সম্পাদক বর্তমান সভাপতি নুরুল বশরের মতে, এমপির ভাই, বন্ধু ও সহযোগীরা বেপরোয়া ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা এমপির ক্ষমতার জোরেই একথা সবাই জানে। কিন্তু শত প্রশ্ন করলেও পুলিশ মুখ খুলবে না।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ জয় কিছুদিন আগে এমপি বদির মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ বদ কর্মকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার অপকর্ম নিয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে উল্লেখ করে বলেন, এমপির পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ আছে। এটা গোপন করে লাভ নেই।
তবে, বিভিন্ন সময়ে এমপি বদি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাছে দাবি করে বলেছেন, বৈধ ব্যবসা করেই তিনি সম্পদ অর্জন করেছেন এবং সংসদীয় আসনের দরিদ্র লোকজনকে তা বিতরণ করে আসছেন।
এদিকে এত অভিযোগে তুমুল ঘৃণিত এমপি বদি বর্তমানে এমপি না হওয়ার পরেও স্থানীয় দু উপজেলায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশ ক্ষেত্র বিশেষ সেখানকার থানার ওসিদের পর্যন্ত হুকুম দেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।