ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বিশ্বের অনেক দেশেই আরবি সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার শোম্বা হিসেবে স্মরণ করা হয়,আজ পবিত্র আখেরি চাহার সোম্বা।আজ ২৭ সফর ১৪৪৫ হিজরি ১৩সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং পবিত্র আখেরি চাহার সোম্বা বা মহানবী (সা.)-এর রোগমুক্তি দিবস।প্রতিবছর হিজরি সালের সফর মাসের শেষ বুধবার মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্মারক দিবস হিসেবে পবিত্র আখেরি চাহার সোম্বা উদযাপিত হয়।
‘আখেরি চাহার শোম্বা’ কথাটি ফার্সি। এর অর্থ হলো শেষ বুধবার। সাধারণ পরিভাষায় আখেরি চাহার শোম্বা বলে সফর মাসের শেষ বুধবারকে বোঝানো হয়ে থাকে। বলা হয় যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যে অসুস্থতার মধ্যে রবিউল আওয়াল মাসের শুরুভাগে ইন্তিকাল করেন, সফর মাসের শেষ বুধবারে অর্থাৎ আখেরি চাহার শোম্বায় সে অসুস্থতা থেকে কিছুটা সুস্থতা বোধ করেছিলেন। তাই এ দিবসটিকে খুশির দিন হিসেবে উদযাপন করা হয়। অথচ এ তথ্য বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। এটা অবশ্য বর্ণিত হয়েছে যে, মৃত্যুর ক’দিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন। আম্মাজান আয়িশা (রা.) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন, তাঁর অসুস্থতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার উপরে ৭ মশক পানি ঢালো, যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি।’ তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম…। এরপর তিনি মানুষদের নিকট বেরিয়ে গিয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে ওয়ায-নসিহত করলেন।” [বুখারি, আসসাহিহ]
এখানে স্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে গিয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নসিহত করতে পারেন। এই গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদিসের কোন বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি (রহ.) বুখারি ও মুসলিমের অন্যান্য হাদিসের সাথে এই হাদিসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এই গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ইন্তিকালের ৫ দিন আগে। ১২ই রবিউল আওয়াল ইন্তিকাল হলে, গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ৮ই রবিউল আউয়াল।
প্রথমত খানিকটা সুস্থতার ঘটনাটাই প্রমাণিত নয়, আর গোসলের ঘটনাটা সফর মাসে নয়, রবিউল আওয়াল মাসে। এখান থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত এ আখেরি চাহার শোম্বা ভিত্তিহীন একটি ব্যাপার।
মূল ঘটনাটাই যেহেতু প্রমাণিত নয়, সুতরাং এর ফযিলত থাকাটাও সম্ভব নয়। এরপরও এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ভিত্তিহীন বানোয়াট বর্ণনা পেশ করা হয়। যেমন বলা হয়, বুধবার অশুভ এবং যেকোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ (জাহিলি আরবদের মিথ অনুযায়ী), সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে অশুভ দিন এবং এই দিনে সবচেয়ে বেশি বালা-মুসিবত নাযিল হয়…।’ আরও বলা হয়, ‘সফর মাসে এক লাখ বিশ হাজার বিপদাপদ নাযিল হয় এবং সবচেয়ে বেশি আখেরি চাহার শোম্বা তথা সফর মাসের শেষ বুধবারে নাযিল হয়।’
উপরের কোনো একটি বর্ণনাও আমরা কোন সহিহ বা যয়িফ হাদিসেও পাইনি। আর ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোন মুসলিম সমাজে ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’ পালনের রেওয়াজও নেই। সাহাবা, তাবিয়িন, তাবি তাবিয়িন বা পরবর্তী যুগের অনুসরণীয় মুসলিমরা কখনোই এধরনের কোনো অনুষ্ঠান পালন করেননি। সুতরাং এত্থেকে বেঁচে থাকা একান্ত জরুরি।
সরকারিভাবে ঐচ্ছিক ছুটি পালন করা হয়। কিন্তু কোরআন, হাদিসের আলোকে আমরা মনে করি এগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। অনুরূপ ভিত্তিহীন ওপরে উল্লিখিত ঘটনা ।
> এর কয়েকটি কারণ আছেঃ-১.রাসুল (সা.)-এর ওপর এক ইহুদি জাদু করেছিল। এটা ছিল হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে সপ্তম হিজরির মহররম মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। এই জাদুর প্রভাব কত দিন ছিল, সে সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, অন্য বর্ণনায় এসেছে ৪০ দিনের কথা। তবে যাই হোক, সুস্থতার তারিখ কোনোভাবেই ১১ হিজরির সফর মাসের ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ বা ‘শেষ বুধবার’ হতে পারে না। (ফাতহুল বারি : ১০/২৩৭, আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া : ২/১৫৪, শরহুজ জুরকানি : ৯/৪৪৬-৪৪৭)
২. রাসুল (সা.)-এর সুস্থতার জন্য যে সাত কুয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তাঁর দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল, তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার ও ইবনে কাসির একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। (ফাতহুল বারি : ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাজি : ৪৪৪২, বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১৯৩, সীরাতুন নবী, শিবলী নোমানী : ২/১১৩)
৩ . এ তথ্যও সঠিক নয় যে বুধবারের পর রাসুল (সা.) আর গোসল করেননি। কেননা এরপর এক রাতে এশার নামাজের আগে গোসল করার কথা সহিহ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। (মুসলিম, হাদিস : ৪১৮, বুখারি, হাদিস : ৬৮১)। আর এ কথাও ঠিক নয় যে বুধবারের পর সুস্থতায় কোনোরূপ উন্নতি হয়নি। বরং এরপর আরেক দিন সুস্থবোধ করেছিলেন এবং জোহরের নামাজে শরিক হয়েছিলেন। (বুখারি , হাদিস : ৬৬৪, ৬৮০, ৬৮১, মুসলিম, হাদিস : ৪১৮) এমনকি সোমবার সকালেও সুস্থবোধ করেছিলেন। যার কারণে হজরত আবু বকর (রা.) অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক পৃ. ৭১১-৭১২, আর রাওজাতুল উলুফ : ৭/৫৪৭-৫৪৮)
৪ . রাসুল (সা.)-এর সুস্থতার কারণে খুশি হওয়া কিংবা তাঁর সুস্থতার সংবাদ পড়ে আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ কথা দাবি করা প্রমাণহীন যে সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী যুগের মনীষীরা সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন কিংবা একে উদযাপনের দিবস ঘোষণা করেছেন। এ দাবির সপক্ষে দুর্বলতম কোনো দলিলও বিদ্যমান নেই।
৫. রাসুল (সা.)-এর ওপর অনেক মসিবত এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও ওহুদে আহত হয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এসব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে দিবস উদযাপনের কোনো নিয়ম আছে? তাহলে আখেরি চাহার শোম্বা যার কোনো ভিত্তি নেই, তা কিভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে!
৬. কোনো দিনকে বিশেষ ফজিলতের দিবস মনে করা কিংবা বিশেষ কোনো আমল তাতে বিধিবদ্ধ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা কিংবা তাকে ধর্মীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা শরিয়তের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এগুলো ইসলামী শরিয়তের দলিল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে তা সাব্যস্ত করা যায় না। এটি শরিয়তের একটি অবিসংবাদিত মূলনীতি। সুতরাং উপরোক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওই সব রসম-রেওয়াজ জারি করার কোনো বৈধতা সাব্যস্ত হয় না,সর্বাবস্থায় কেউ কোনভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনোদিন সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই ইন্তেকালের কয়েক দিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ বুখারীতে আয়েশা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে। (সহীহ বুখারী – ১/৮৩, ৪/১৬১৪, ৫/২১৬০)এ গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটে ছিল, তা হাদিসে কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনূ হাজার আসকালানী রা. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদিসের সাথে সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এ গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তেকালের আগের বৃহস্পতিবার।
অর্থাৎ ইন্তেকালের ৫ দিন আগে।১২ রবিউল আওয়াল ইন্তেকাল হলে গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ৮ রবিউল আওয়াল। উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার বা আখেরি চাহার শোম্বায় রাসূল সা. এর গোসল দেওয়া, সুস্থ হওয়া, ইমামতি করার ও লোকদের উপদেশ দেওয়া এবং সাহাবীগণ আনন্দিত হয়ে দান সদাকাহ করার কাহিনীর কোনরূপ ভিত্তি নেই।
পরিশেষে বলতে চাই,আখেরি চাহার সোম্বা পালন করতেই হবে এমনটি নয়; তবে এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই। তাছাড়া প্রত্যেক আরবি মাসেই রয়েছে সুন্নাত ইবাদতের দিকনির্দেশনা। আবার আছে সাপ্তাহিক ইবাদতের দিকনির্দেশনা। যা পালনে রয়েছে অনেক মর্যাদা ও সাওয়াব। যেমন-প্রত্যেক সপ্তাহে জুমআর দিনের ইবাদত। সোম ও বৃহস্পতিবারে রোজা পালন। আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়মিত আমল ছিল প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে নফল রোজা রাখা। যাকে আইয়ামে বিজের রোজা বলা হয়ে থাকে।সুতরাং সফর মাসের বিশেষ কোনো ঘটনা বা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষ মতভেদ না করাই উত্তম। হাদিসের অনুসরণ ও অনুকরণে নেক আমল ও ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত করলেই মিলবে অনেক সাওয়াব। সফর মাসকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ইবাদাত নয় বরং আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট সব দিন-রাত-মাসের ইবাদাত-বন্দেগি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ; সেহেতু দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ লাভে এবং উভয় জগতের সকল অপকারিতে ও অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকতে নফল নামাজ, আইয়ামের বিজের রোজা পালন এবং দান-সাদকায় আত্মনিয়োগ করা জরুরি।আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা দান করুন এবং সব ধরনের রসম-রেওয়াজ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
লেখক,
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
ইমেইল, drmazed96@gmail.com