বানী ডেস্ক :
পর্যটন শহর কক্সবাজারের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিনোদন স্পট সাগর তীরবর্তী হোটেল-মোটেল জোনের কলাতলী। এই স্পট ঘিরে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধচক্র। সন্ত্রাসীদের আস্তানা, বখাটেপনা, মাদক বাণিজ্য, দেহ ব্যবসাসহ নানামুখী অপরাধ এখন ওপেন সিক্রেট। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসা লোকজন নিজেদের অনিরাপদবোধ করছেন। এতে স্থানীয়রা সব সময় থাকেন আতঙ্কে ও উদ্বেগে।
কলাতলী কটেজ জোনে গভীর রাত পর্যন্ত বেপরোয়া মোটরসাইকেল রেসিংয়ে মগ্ন থাকে অপরাধ জড়তে পা বাড়ানো কিশোর ও তরুণ গ্যাং। চলে কার রেসিংও। এতে প্রভাবিত হয় আশপাশের তরুণ-যুবকরা। এখানে গাড়ি ও দৃষ্টিনন্দন হোটেল-কটেজে বসে চলে মাদকের বেচাকেনা। ঘুরতে আসা তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে বখাটেরা। এ কারণে কলাতলীর আশপাশের বাসিন্দারাও অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিপরীতে গড়ে ওঠা কটেজ জোনটি একটি ‘মিনি যৌনপল্লী’ হিসেবে পরিচিত। যেখানে মাদক, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয়। কটেজের মালিক, ম্যানেজার, বয়সহ সংঘবদ্ধ চক্র এসব অপরাধে জড়িত।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই কলাতলীর বিভিন্ন কটেজে বসে মাদকসেবীদের আসর। আর অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে। চলে ছিনতাই, অসামাজিক কার্যকলাপ। ওই এলাকা মাঝে মাঝে অভিযান চললেও অপরাধীরা বেপরোয়া।
তথ্য সূত্রে জানা গেছে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিপরীতে সৈকত আবাসিক এলাকায় ৮০টি ছোট ছোট আবাসিক হোটেল নিয়ে গড়ে উঠেছে কটেজ জোন, যা দিনদিন যেন অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে।
এই কটেজ জোন ঘিরে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত নেতিবাচক সংবাদ দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে দুই কিশোরীকে অপহরণ করে এই জোনের রাজন কটেজে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়।
এই এলাকাকেন্দ্রিক ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর স্থানীয় এক স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ছাড়া ২০২২ সালের ৮ আগস্ট ট্যুরিস্ট পুলিশ এক অভিযানে ৪ কিশোরকে উদ্ধার করে গ্রেপ্তার করেছিল ১১ জনকে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ তখন জানিয়েছিল, একটি কটেজকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধ করছে সংঘবদ্ধ চক্র। চলতি বছরের ২১ মে র্যাব অভিযান চালিয়ে নারীসহ পাঁচজনকে উদ্ধার করে তিনজনকে গ্রেফতার করে করে।
র্যাব জানিয়েছিল, ওই কটেজটিও অপরাধীদের টর্চার সেল। শুধু তা-ই নয়, এই কটেজ জোন থেকে গত দুই বছরে ২২ জনের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে।
হোটেল ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিদিন বিকেলে হওয়ার সাথে সাথে বখাটে ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন কেটেজে। একাধিক গ্রুপে ভাগ হয়ে নানামুখী উচ্ছৃঙ্খলতা আর খোলামেলা মাদক সেবনে রীতিমতো হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি করে তারা। বিশেষ করে কটেজ জোন ও লাইট হাউস এলাকায় অবিস্থত বিভিন্ন ফ্লাট বাসায় বখাটে তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এই কটেজ জোনটি স্বঘোষিত কটেজ জোন নেতা হানিফ, নুরুল হুদা, রফিক, আবুলসহ কয়েকজনের নিয়ন্ত্রণে। যেখানে ৮০টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে ৪ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে চক্রটি। জেলা ও ট্যুরিস্ট পুলিশকে ম্যানজের কথা বলে আদায় করা হয় এই চাঁদা।
কটেজ জোনকে পতিতাবৃত্তি ও অপরাধের আখড়া বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার আবাসিক হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার।
তিনি জানান, ওই জোনটিতে যৌনকর্মী-খদ্দেরের উপদ্রব আশঙ্কাজনক। বিভিন্ন সময় সেখানে নানা অপরাধের কারণে পর্যটন শিল্প নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা উচিত।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন সময় কটেজ জোনকেন্দ্রিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ অভিযান পরিচালনা করেছে। যেখান থেকে বিভিন্ন সময় যৌনকর্মী, খদ্দের আটকের মামলা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে মাদকও। এখন নতুন করে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।